বাংলাদেশের বাজারে ইসরায়েলি সম্পৃক্ততা থাকা পণ্যসমূহ

বাংলাদেশের সাথে ইসরায়েলের কোনো কূটনৈতিক বা সরাসরি বাণিজ্যিক সম্পর্ক নেই। সরকারি নীতি অনুসারে ইসরায়েলের সাথে সরাসরি বাণিজ্য নিষিদ্ধ এবং পাসপোর্টেও একসময় “Except Israel” কথাটি উল্লেখ থাকত​ ।

তবুও বিভিন্ন পণ্য ও প্রযুক্তি সময়ে সময়ে পরোক্ষ পথে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে বা ব্যবহার করা হয়েছে, যেগুলোর পেছনে ইসরায়েলি কোম্পানি বা বিনিয়োগকারীর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। নিচে বাংলাদেশে বর্তমান বা অতীতে পাওয়া এমন পণ্যের তালিকা বিভাগভিত্তিক উপস্থাপন করা হলো। প্রতিটি ক্ষেত্রে পণ্যের পরিচয়, সংশ্লিষ্ট ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশে ব্যবহারের ধরণ এবং সংশ্লিষ্ট বিতর্ক/আলোচনা উল্লেখ করা হয়েছে।

নিরাপত্তা ও নজরদারি প্রযুক্তি

বাংলাদেশে সবচেয়ে আলোচিত ইসরায়েলি সম্পৃক্ত পণ্যগুলোর বেশিরভাগই বিভিন্ন নজরদারি (spyware) প্রযুক্তি। যদিও বাংলাদেশ সরকার ইসরায়েলি প্রযুক্তি কেনার কথা অস্বীকার করে, তদন্তমূলক প্রতিবেদনে বারবার প্রকাশ পেয়েছে যে বাংলাদেশি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তৃতীয় দেশের মাধ্যমে ইসরায়েলি নজরদারি সরঞ্জাম সংগ্রহ করেছে​।

আরেকটি সোর্স লিংক

এসব ঘটনায় মানবাধিকার ও গোপনীয়তা লঙ্ঘনের শঙ্কা এবং রাষ্ট্রীয় নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। নিচে এমন কিছু নজরদারি পণ্য তুলে ধরা হলো:

  • P6 Intercept IMSI-ক্যাচার: ইসরায়েলি সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের প্রতিষ্ঠিত PicSix Ltd. কোম্পানির তৈরি মোবাইল ফোন নজরদারি সিস্টেম, যা ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা DGFI পরোক্ষভাবে ক্রয় করে​। এটি একটি মোবাইল IMSI-catcher যন্ত্র, যা একই সঙ্গে শত শত ফোনের সিগনাল মনিটর ও আটকাতে সক্ষম বলে Privacy International-এর বিশ্লেষকরা জানান​। চুক্তিপত্রে দেশ‐উৎপত্তি হাঙ্গেরি হিসেবে ভুয়া তথ্য দেওয়া হয়েছিল যেন “কেউ বুঝতে না পারে যে পণ্যটি ইসরায়েল থেকে এসেছে”। গোপনে এই প্রযুক্তি এনে বিরোধী কর্মকাণ্ড নজরে রাখতে ব্যবহার করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উঠে আসে​। ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক না রেখেও এমন ক্রয় রাষ্ট্রীয় নীতি ও গোপনীয়তার প্রশ্নে বিতর্ক সৃষ্টি করে।
  • Cellebrite UFED ফোন-হ্যাকিং ডিভাইস: ইসরায়েলি কোম্পানি Cellebrite উদ্ভাবিত UFED ডিভাইসের মাধ্যমে স্মার্টফোনের লক ভেঙে ভেতরের সমস্ত ডেটা বের করা যায়। আল জাজিরা ও ইসরায়েলি পত্রিকা হারেটজের পাওয়া নথি অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার কমপক্ষে $৩৩০,০০০ খরচ করে এই প্রযুক্তি কিনেছে এবং ২০১৯ সালে পুলিশের গোয়েন্দা শাখার ৯ জন কর্মকর্তাকে সিঙ্গাপুরে গিয়ে এর ব্যবহারে প্রশিক্ষণ নিতে পাঠানো হয়​। এই ডিভাইসের মাধ্যমে ফোনের মেসেজ, ইমেইল, ছবি থেকে শুরু করে মুছে ফেলা তথ্যও উদ্ধার করা সম্ভব। বাংলাদেশে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) সহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এই সেলিব্রাইট প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে​। দেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনে অভিযুক্ত সংস্থাগুলোর হাতে একটি ইসরায়েলি হ্যাকিং সরঞ্জাম তুলে দেওয়ার বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলেও উদ্বেগ তৈরি করেছে।
  • SpearHead নজরদারি ভ্যান: ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর سابق গোয়েন্দা ইউনিটের প্রধানের নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান WiSpear/Passitora নির্মিত একটি অত্যাধুনিক মোবাইল নজরদারি ব্যবস্থা, যা “SpearHead” নামে পরিচিত​। একটি ভ্যানে স্থাপিত এই সিস্টেম কাছাকাছি অর্ধ-কিলোমিটার এলাকাজুড়ে মোবাইল ফোন ও কম্পিউটারে গোপনে স্পাইওয়্যার ঢুকিয়ে তথ্য আহরণ করতে পারে। গোপন নথি থেকে জানা গেছে, ২০২২ সালের জুনে একটি SpearHead সিস্টেম সুইজারল্যান্ড হয়ে ঢাকায় পৌঁছানো হয়; সরবরাহকারী ছিল Passitora এবং ক্রেতা ছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ জাতীয় টেলিযোগাযোগ মনিটরিং কেন্দ্র (NTMC)​। প্রায় ৯৯১ কেজি ওজনের এই চালানে নজরদারি সরঞ্জাম ও সফটওয়্যার অন্তর্ভুক্ত ছিল​business-humanrights.org। ২০২1 সালে মন্ত্রিসভায় “ভেহিকেল মাউন্টেড মোবাইল ইন্টারসেপ্টর” কেনার সিদ্ধান্তে একটি সুইস কোম্পানি (যার CEO ইসরায়েলি নাগরিক​business-humanrights.org) মাধ্যমে SpearHead সরবরাহের অনুমোদন দেওয়া হয়​business-humanrights.org। প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে যে এডভান্সড এই স্পাই ভ্যানটি ইতিমধ্যে বাংলাদেশে চালু হয়েছে এবং এর মাধ্যমে হোয়াটসঅ্যাপে সরকারবিরোধী আলোচনা শনাক্ত করে কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে​business-humanrights.org। ইসরায়েল সরকার বাংলাদেশে এমন সফটওয়্যার রপ্তানির অনুমতি না দিলেও তৃতীয় দেশের মাধ্যমে এই প্রযুক্তি পৌঁছানোয় নীতি এবং গোপনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
  • Prelysis Wi-Fi গোয়েন্দা সিস্টেম: Prelysis নামের একটি ইসরায়েলি-সাইপ্রাস নিবন্ধিত কোম্পানি থেকে বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা NSI একটি উন্নত Wi-Fi যোগাযোগ আটকানোর সিস্টেম ২০১৯ সালে গোপনে ক্রয় করে​business-humanrights.org। সাইপ্রাসের রপ্তানি রেকর্ড অনুযায়ী ২০১৯ সালের জুলাইয়ে প্রায় $৩০ লাখ মূল্যের ওয়াই-ফাই ইন্টারসেপশন সরঞ্জাম বাংলাদেশে পাঠানো হয়​business-humanrights.org। Prelysis-এর প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক ইসরায়েলি নাগরিক কোবি নবেহ​business-humanrights.org। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া এমন প্রযুক্তি রপ্তানি নীতিবহির্ভূত হলেও, এখানে সাইপ্রাসকে উৎস দেখিয়ে লেনদেন সম্পন্ন হয়​business-humanrights.org। এই সিস্টেম দিয়ে আশপাশের ওয়্যারলেস ইন্টারনেট ট্র্যাফিক আড়ি পেতে মনিটর করা যায়, যা নাগরিক গোপনীয়তার জন্য হুমকি বলে অভিমত ব্যক্ত করা হয়।
  • Coralco Tech মোবাইল মনিটরিং যন্ত্র: সিঙ্গাপুরে নিবন্ধিত কিন্তু ইসরায়েলি মালিকানাধীন কোম্পানি Coralco Tech ২০১৯ সালে বাংলাদেশি সামরিক সংস্থার কাছে “সক্রিয় মোবাইল ফোন মনিটরিং” সরঞ্জাম সরবরাহ করে, যার মূল্য ধরা হয়েছিল প্রায় $১৬ লাখ​business-humanrights.org। সিঙ্গাপুরের রেজিস্ট্রারে এ কোম্পানির মালিক হিসেবে ইসরায়েলি উদ্যোক্তা এয়াল আলমোগ-এর নাম রয়েছে এবং একই ঠিকানা ও নামে প্রতিষ্ঠানটি ইসরায়েলেও নিবন্ধিত​business-humanrights.org। এই সরঞ্জামটি সম্ভাব্যভাবে মোবাইল ফোনের ভেতরের যোগাযোগ পর্যবেক্ষণে ব্যবহৃত হয়। Coralco দাবি করেছে যে তারা যথাযথ কর্তৃপক্ষের লাইসেন্স নিয়ে এবং মানবাধিকার যাচাই সাপেক্ষে পণ্য বিক্রি করে থাকে​business-humanrights.org। তবুও গোপনে বাংলাদেশে এমন প্রযুক্তি বিক্রির তথ্য বের হওয়ায় সমালোচনা হয়।
  • U-TX/Cognyte ওয়েব ইন্টেলিজেন্স ও ট্র্যাকিং সিস্টেম: U-TX Technologies মূলত ইসরায়েলি উদ্যোক্তাদের দ্বারা সাইপ্রাসে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যা পরে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল যৌথ কোম্পানি Verint অধিগ্রহণ করে এবং ২০২১ সালে তাদের নিরাপত্তা বিভাগ ভেঙে Cognyte নামে একটি স্বাধীন ইসরায়েলভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গঠন করে​business-humanrights.org। এই U-TX (বর্তমানে Cognyte) ২০১৯ সালে NTMC-এর জন্য প্রায় $২০ লাখ মূল্যের একটি Web Intelligence সিস্টেম সরবরাহ করে, যা ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়া নজরদারির কাজে লাগে​business-humanrights.org। একই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২০২১ সালে বাংলাদেশ সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার জন্য $৫ লাখ মূল্যে একটি সেলুলার লোকেশন ট্র্যাকিং সিস্টেম কেনা হয়​business-humanrights.org। অর্থাৎ, ইসরায়েলি সফটওয়্যার কোম্পানি Cognyte (পূর্বে Verint/U-TX) বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নজরদারিতে পরোক্ষভাবে প্রযুক্তি সরবরাহ করেছে। এসব লেনদেনও সাইপ্রাস ও সিঙ্গাপুরের শাখা মাধ্যমে সম্পন্ন হয় এবং সরাসরি ইসরায়েলি উৎস ঢাকা পড়ে থাকে​business-humanrights.org
  • Pegasus স্পাইওয়্যার: NSO Group নামের কুখ্যাত ইসরায়েলি সাইবার-সশস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের তৈরি Pegasus স্পাইওয়্যার বিশ্বব্যাপী সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী ও রাজনীতিবিদদের ফোনে আড়ি পেতে ব্যবহৃত হওয়ার তথ্য ২০২১ সালে ফাঁস হয়। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিটিজেন ল্যাবের প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে ৪৫টি দেশের তালিকায় পাওয়া গেছে যেখানে পেগাসাস স্পাইওয়্যার অপারেশন শনাক্ত হয়েছেthedailystar.net। ২০১৬-২০১৮ সময়কালে “GANGES” কোডনামে একটি অপারেটর বাংলাদেশে পেগাসাস ব্যবহার করেছে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যায়​citizenlab.ca। অর্থাৎ বাংলাদেশের কিছু মোবাইল ফোন এই ইসরায়েলি সফটওয়্যারে আক্রান্ত হয়েছিল। ধারণা করা হয়, হয়তো সরকারি কোনো সংস্থা বা কোনো তৃতীয় পক্ষ দেশটিতে বিরোধী রাজনীতিক ও সমালোচকদের ওপর নজরদারির জন্য পেগাসাস ব্যবহার করেছে। এ নিয়ে国内及 আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র উদ্বেগ ও সমালোচনা হয়। তবে বাংলাদেশ সরকার পেগাসাস ক্রয় বা ব্যবহারের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে অস্বীকার করেছে বলে বিভিন্ন খবরে উল্লেখ রয়েছে।

উপরের নজরদারি প্রযুক্তিগুলোর ব্যবহার নিয়ে দেশে বিতর্কের মূল বিষয় হলো – একদিকে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো গোপনে নাগরিকদের ওপর নজরদারি করছে, এবং অন্যদিকে বাংলাদেশ-ইসরায়েল বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে পরোক্ষ চ্যানেলে এসব পণ্য কেনা হয়েছে​

aljazeera.com। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে এই প্রযুক্তি ব্যবহারে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা হুমকির মুখে পড়ছে। অন্যদিকে সরকার পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, তারা সরাসরি ইসরায়েল থেকে কিছু কেনেনি এবং জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে প্রয়োজনে যেকোনো উৎস থেকে প্রযুক্তি নেওয়া হতে পারে। বিষয়গুলো নিয়ে দেশব্যাপী আলোচনা-সমালোচনা অব্যাহত রয়েছে।

ডিজিটাল প্রযুক্তি ও সফটওয়্যার

বাংলাদেশের সাধারণ ব্যবহারকারী পর্যায়ে কিছু ডিজিটাল পণ্য ও সেবা রয়েছে যেগুলোর সাথে ইসরায়েলি উদ্যোক্তা বা প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতা আছে। এসব অ্যাপ বা সফটওয়্যার বহুজাতিক পণ্য হিসেবে পরিচিত হওয়ায় অনেকেই জানেন না যে এগুলোর শিকড় ইসরায়েলে। নিচে এমন কয়েকটি প্রযুক্তিপণ্য উল্লেখ করা হলো:

  • Viber মেসেজিং অ্যাপ: বিনামূল্যে ভয়েস কল ও বার্তা পাঠানোর জনপ্রিয় অ্যাপ Viber এর প্রতিষ্ঠাতা ইসরায়েলি উদ্যোক্তা তালমন মার্কোসহ একটি দল এবং এটি প্রথম উন্নয়নও হয়েছিল ইসরায়েলে​timesofisrael.com। ২০১৪ সালে জাপানি কোম্পানি রাখুতেন প্রায় $৯০০ মিলিয়নে এই অ্যাপটি কিনে নিলেও এর গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্র ইসরায়েলেই ছিল এবং অ্যাপটি ইসরায়েলি-সংশ্লিষ্ট উদ্ভাবন হিসেবেই স্বীকৃত​timesofisrael.com। বিশ্বব্যাপী ২০০ মিলিয়নের বেশি ব্যবহারকারী রয়েছে Viber-এর এবং মধ্যপ্রাচ্যসহ বহু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে এটি ব্যাপক ব্যবহার হয়, যা একটি ব্যতিক্রমী বিষয় (কারণ এটি ইসরায়েলে তৈরি অ্যাপ)​timesofisrael.com। বাংলাদেশেও Viber খুবই জনপ্রিয় একটি যোগাযোগ মাধ্যম, বিশেষ করে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ফ্রি কল করার সুবিধার কারণে অনেক মানুষ হোয়াটসঅ্যাপ বা ইমোর পাশাপাশি ভাইবার ব্যবহার করে থাকেন। এই অ্যাপ নিয়ে দেশে তেমন কোনো বিতর্ক হয়নি, তবে এর ইসরায়েলি উৎসের কথা সচেতন অনেকেই সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে জেনেছেন।
  • Waze ন্যাভিগেশন অ্যাপ: গাড়িচালকদের实时 পথনির্দেশ ও ট্রাফিক তথ্য দেওয়ার অ্যাপ Waze মূলত ইসরায়েলের একটি স্টার্টআপ (Waze Mobile) কর্তৃক তৈরি হয় এবং ২০১৩ সালে Google প্রায় $১ বিলিয়নে এটিকে অধিগ্রহণ করে নেয়​timesofisrael.com। Waze অ্যাপটি ব্যবহারকারীদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জ্যাম, দুর্ঘটনা ইত্যাদি আপডেট দিয়ে পথের সময় কমাতে সাহায্য করে। বাংলাদেশে গুগল ম্যাপস সবচেয়ে জনপ্রিয় ন্যাভিগেশন সেবা হলেও কিছু রাইডশেয়ারিং চালক ও প্রযুক্তিপ্রেমী ব্যবহারকারী Waze ব্যবহার করে থাকেন। অ্যাপটির মূল উদ্ভাবক দল ইসরায়েলে হওয়ায় এটিও ইসরায়েলি প্রযুক্তি ছড়ানোর একটি উদাহরণ। যদিও বাংলাদেশে এটি নিয়ে কোনো বিতর্ক দেখা যায়নি, তবে ইসরায়েলের সঙ্গে নাম জড়িয়ে থাকা আরেকটি প্রযুক্তি হিসেবে এর নাম উল্লেখযোগ্য।
  • Fiverr ফ্রিল্যান্স মার্কেটপ্লেস: বিশ্বজুড়ে ফ্রিল্যান্স কাজের অন্যতম বড় অনলাইন প্ল্যাটফর্ম Fiverr এর সদরদপ্তর ও প্রতিষ্ঠাকালীন পরিবেশ ইসরায়েলে। Fiverr একটি ইসরায়েলি বহুজাতিক অনলাইন মার্কেটপ্লেস, যেখানে ফ্রিল্যান্সাররা বিভিন্ন সেবা অফার করে এবং ক্লায়েন্টরা তা ক্রয় করে থাকে​en.wikipedia.org। বাংলাদেশের হাজারো ফ্রিল্যান্স তরুণ-তরুণী Fiverr এর মাধ্যমে ওয়েব ডিজাইন, কন্টেন্ট রাইটিং, ডিজিটাল মার্কেটিংসহ বিভিন্ন কাজ করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছেন। ২০১৯ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিন বৈশ্বিক ফ্রিল্যান্স আয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে শীর্ষ ১০ দেশেরหนึ่ง বলে উল্লেখ করেthedailystar.net – আর এই সাফল্যের পেছনে Fiverr-এর মতো প্ল্যাটফর্মের বড় ভূমিকা রয়েছে। সাম্প্রতিক গাজা সংকটের প্রেক্ষিতে কিছু সচেতন মহল Fiverr বর্জনের কথা তুলেছেন এর ইসরায়েলিসূত্রের জন্য, তবে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে এর ব্যবহার যথেষ্ট প্রচলিত রয়েছে এবং সরাসরি কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।
  • অন্যান্য সফটওয়্যার ও সেবা: আরও কিছু জনপ্রিয় ডিজিটাল সেবা ও সফটওয়্যার আছে যেগুলোর সাথে ইসরায়েলি উদ্ভাবনের যোগসূত্র রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, পুরানো সময়ের জনপ্রিয় মেসেঞ্জার ICQ (৯০-এর দশকে বিশ্বজুড়ে ব্যবহৃত ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং অ্যাপ) ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান Mirabilis দ্বারা তৈরি হয়েছিল। আবার বহুজাতিক প্রযুক্তি কোম্পানি Intel এর অনেক আধুনিক প্রসেসর (যেমন Centrino) ইসরায়েলের研发 কেন্দ্রে ডিজাইন করা, যার ব্যবহার বাংলাদেশেও প্রচুর কম্পিউটার ও মোবাইল ডিভাইসে আছে। এসব ক্ষেত্রে পণ্যগুলো সরাসরি “ইসরায়েলি” হিসেবে পরিচিত না হলেও এদের পেছনে ইসরায়েলি জ্ঞান-বিনিয়োগ জড়িয়ে রয়েছে। বাংলাদেশে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে সাথে বিভিন্ন দেশে উদ্ভাবিত সফটওয়্যার-পণ্য পৌঁছে যাচ্ছে, যার মধ্যে ইসরায়েলও একটি উৎসস্থান। তবে এসব পণ্য নিয়ে তেমন জনপর্যায়ে আলোচনা হয় না, কারণ বেশিরভাগই ভোক্তারা উৎস না জেনেই ব্যবহার করে থাকেন।

ভোক্তা ও কৃষি পণ্য

বাংলাদেশের বাজারে বহুল ব্যবহৃত ভোক্তা পণ্যের তালিকায় সরাসরি ইসরায়েলি ব্র্যান্ড দেখা যায় না, কারণ আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েল থেকে পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ। তবে কিছু পণ্য পরোক্ষভাবে বা ছদ্মবেশে বাজারে এসেছে বলে ধারণা করা হয়, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমদানি করা ভোগ্যপণ্যের মধ্যে। নিচে এ ধরনের কিছু পণ্যের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হলো:

  • মেজুল খেজুর (Dates): খেজুর বিশেষত রমজান মাসে বাংলাদেশের একটি অত্যন্ত চাহিদাসম্পন্ন ভোগ্যপণ্য। সাধারণত সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া প্রভৃতি দেশ থেকে বাংলাদেশে খেজুর আমদানি হয়। কিন্তু বিশ্ববাজারে উচ্চমানের মেজুল খেজুর উৎপাদনে এবং রপ্তানিতে ইসরায়েল শীর্ষস্থানীয়bangla.dhakatribune.com। ইসরায়েল ২০২১ সালে বিশ্বজুড়ে প্রায় ১১ কোটি ৪৬ লাখ কেজি খেজুর রপ্তানি করেছে​bangla.dhakatribune.com, যা থেকে অনুমান করা হয় যে বিভিন্ন মধ্যস্থ দেশ হয়ে ইসরায়েলি খেজুরও অনেক দেশে প্রবেশ করছে। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মতো মুসলিম দেশগুলোতে সাম্প্রতিক সময়ে জানা গেছে যে ভুল লেবেল লাগিয়ে ইসরায়েলি খেজুর বিক্রি করা হচ্ছিল এবং ধরা পড়ার পর সেই দেশগুলো ইসরায়েলি খেজুর বর্জনের ডাক দিয়েছে​dailyjanakantha.com। বাংলাদেশেও সরাসরি তথ্য না মিললেও আশঙ্কা করা হয় যে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো লেবেলে ইসরায়েলি খেজুর ঢুকে পড়তে পারে। সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই রমজানে খেজুর কেনার সময় উৎপত্তি দেশ যাচাই করতে পরামর্শ দিয়ে থাকেন, যাতে অজান্তে কেউ ইসরায়েলি খেজুর কিনে না ফেলেন। ফলে খেজুর নিয়ে সচেতনতা থাকলেও এখন পর্যন্ত কোনো সরাসরি ঘটনা প্রকাশ্যে আসেনি যেখানে বাংলাদেশে ইসরায়েল থেকে খেজুর আমদানির প্রমাণ পাওয়া গেছে। তারপরও এটি ভোক্তা পর্যায়ে ইসরায়েলি পণ্যের সম্ভাব্য উপস্থিতির একটা গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ।
  • কৃষি প্রযুক্তি ও বীজ: ইসরায়েল বিশ্বখ্যাত তার উন্নত ফসলের বীজ, ড্রিপ সেচ প্রযুক্তি ও কৃষি উদ্ভাবনএর জন্য​climateadaptationplatform.com। বাংলাদেশের কৃষিতে সরাসরি ইসরায়েলি অংশগ্রহণ না থাকলেও, পরোক্ষভাবে কিছু প্রযুক্তি ব্যবহৃত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারত বা অন্যান্য দেশের মাধ্যমে ইসরায়েলি উন্নতজাতের সবজির বীজ বা সেচ সরঞ্জাম বাংলাদেশে আসতে পারে। তবে নির্দিষ্টভাবে তথ্যপ্রমাণসহ কোনো ইসরায়েলি কৃষিপণ্য বাংলাদেশের কৃষক বা বাজারে এসেছে বলে উল্লেখযোগ্য প্রতিবেদন মেলে না। বাংলাদেশের কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাথে ইসরায়েলের কোনো যৌথ উদ্যোগের খবরও জানা যায়নি নিষেধাজ্ঞার কারণে। কাজেই এ খাতে ইসরায়েলি পণ্যের উপস্থিতি থাকলেও তা খুব সীমিত এবং অনৌপচারিক (informal channel) পর্যায়ে।
  • ভোক্তা ইলেকট্রনিক্স ও অন্যান্য: দৈনন্দিন ব্যবহারের ইলেকট্রনিক পণ্য – যেমন মোবাইল ফোন, টেলিভিশন, গৃহস্থালি যন্ত্রপাতি – এ ক্ষেত্রে ইসরায়েলি ব্র্যান্ড সরাসরি নেই। বাংলাদেশের বাজারে স্যামসাং, অ্যাপল, শাওমি, ওয়ালটন ইত্যাদি শীর্ষে, যেগুলোর সাথে ইসরায়েলের সংশ্লিষ্টতা নেই। তবে কিছু পণ্যের অভ্যন্তরে ব্যবহৃত উপাদানে ইসরায়েলি প্রযুক্তি থাকতে পারে (যেমন ইন্টেল চিপ বা সিকিউরিটি সফটওয়্যার), যা সাধারণ ক্রেতাদের নজরে আসে না। তাছাড়া প্রসাধনী সামগ্রী বা ভোগ্য খাবারের মধ্যে যেমন ডেড সি সল্ট দিয়ে তৈরি ইসরায়েলি প্রসাধনী বা ইসরায়েলি কোনো ফুড ব্র্যান্ড – এসব বাংলাদেশে অনুপস্থিত, কারণ আমদানিতে সরকারি নিষেধাজ্ঞা কঠোরভাবে পালন করা হয়​privacyshield.gov। ফলে ভোক্তা পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য কোনো ইসরায়েলি পণ্য বাংলাদেশের দোকান-পাটে প্রকাশ্যে দেখা যায় না।

ভুল ধারণা ও সাম্প্রতিক বিতর্ক

বাংলাদেশে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাতের প্রেক্ষাপটে ইসরায়েলি পণ্য বর্জনের ডাক মাঝে মাঝেই উঠেছে। তবে অনেক সময়ই সোশ্যাল মিডিয়া ও কিছু প্রচারপত্রে ভুলভাবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডকে “ইসরায়েলি পণ্য” বলে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সম্প্রতি ফেসবুকে ছড়ানো কিছু তালিকায় কোকা-কোলা, পেপসি, নেস্টলে, ম্যাগগি, নকিয়া, ম্যাকডোনাল্ডস, ইন্টেল ইত্যাদি বহুজাতিক ব্র্যান্ডের নাম ইসরায়েলি বলে দাবি করা হয়​

m.somewhereinblog.net। আসলে এসব প্রতিষ্ঠানের মূল মালিকানা যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ বা অন্যান্য দেশের বহুজাতিক কোম্পানির হাতে এবং এদের সাথে সরাসরি ইসরায়েলি মালিকানার যোগসূত্র নেই​

bangladesh.factcrescendo.com। ভুল তথ্যের ভিত্তিতে পণ্য বর্জনের আহ্বান জানালে বাস্তবে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি প্রকাশের পরিবর্তে বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে। এজন্য যাচাই করে সত্যিকার ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠানের পণ্য চিহ্নিত করাই গুরুত্বপূর্ণ।

বর্তমানে যেসব পণ্য সত্যিকারের ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত, সেগুলোর মধ্যে নিরাপত্তা ও নজরদারি প্রযুক্তির বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আলোচিত ও উদ্বেগের। ভোক্তা পর্যায়ে কিছু ডিজিটাল অ্যাপ ও সেবা আছে যেগুলো ইসরায়েলি সংস্থার তৈরি, তবে সেগুলো নিয়ে ততটা বিতর্ক নেই যতটা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কেনা নজরদারি সরঞ্জামগুলো নিয়ে আছে। সামগ্রিকভাবে বলা যায়, বাংলাদেশে ইসরায়েলি পণ্য সরাসরি পাওয়া না গেলেও পরোক্ষ উপায়ে বেশ কিছু ক্ষেত্রেই ইসরায়েলি বিনিয়োগকৃত বা নির্মিত পণ্য ব্যবহৃত হচ্ছে। এ বিষয়ে স্বচ্ছতা ও সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সাধারণ জনগণ ও নীতিনির্ধারকরা ভালোভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন যে কোন পণ্যে বিনিয়োগ করবেন বা কোন প্রযুক্তি দেশের জন্য গ্রহণযোগ্য এবং নীতিসম্মত।

রিপোর্টে উল্লিখিত তথ্যগুলো নির্ভরযোগ্য সংবাদসূত্র ও বিশ্লেষণী প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সংগৃহীত। ইসরায়েলি সংশ্লিষ্ট পণ্যের যেকোনো নতুন তথ্য প্রকাশ পেলে তা ভবিষ্যতে এই প্রসঙ্গে আলোচনার গতিপ্রকৃতি বদলে দিতে পারে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ইসরায়েলি পণ্যের বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় প্রত্যেকটি উদাহরণে পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই করে দেখা গুরুত্বপূর্ণ – যাতে গুজবের বদলে বাস্তব তথ্যের আলোকেই জনমত গড়ে ওঠে।

উৎসসমূহ: এই প্রতিবেদনে উল্লেখিত তথ্যসমূহ আল জাজিরা, হারেটজ, টাইমস অব ইসরায়েল, মিডল ইস্ট মনিটর, প্রথম আলো, ডেইলি জনকণ্ঠ, ইত্যাদি বিশ্বস্ত সূত্র থেকে নেওয়া হয়েছে। উদ্ধৃতির শেষে 【সূত্র নম্বর†লাইন】 আকারে সংশ্লিষ্ট উৎসের রেফারেন্স দেওয়া হলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

en_USEnglish